ফেকার #০৫ --- অয়ন আল মামুন


তীব্র রিংটোনের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। কোন বেয়াদব ফোন দেয় এই ভোর বেলায়? কোন রকমে একটা চোখ খুলে দেখলাম কে দিয়েছে ফোনটা। অপরিচিত নম্বর। ধূর, মারা খাও তুমি, ফোন দিয়েছো কেন, হ্যাঁ? একটা বাটনে কোন রকম চাপ দিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে আবার আলসামো শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ফোনটা বেজে উঠল। আজব তো, কোন শালা বিরক্ত করছে এইভাবে? মেজাজটা প্রচুর চড়তে শুরু করেছে। মন চাচ্ছে যে ফোন দিচ্ছে তাকে সামনে পেলে কানের নীচে দেই কিছুক্ষণ। এবার কষ্ট করে আর চোখ ও মেললাম না। আগেরবার দেখে নিয়েছি ফোনটা ঠিক কোথায় আছে। সুন্দরমত ফোনটা সাইলেন্ট করে আবার শান্তি ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিসের কি, ঘুমটা এতক্ষণে নষ্ট হয়ে গেছে।
কয়টা বাজে দেখার জন্য মোবাইলের লক বাটনে টিপ দিলাম। কিহ, সাড়ে দশটা বাজে! আমার যে বেলা বারোটায় ক্লাস ছিল! এক লাফে বিছানা থেকে উঠে পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হতে যাব এমন সময় দিদি ডাক দিলেন।
"এই কিরে! কই যাস?"
"ক্লাস আছে, ভার্সিটি যাই।"
"ক্লাস আছে ভালো কথা। নাস্তা খেয়ে এরপর যা।"
"সময় নাই নাস্তা করার।"
"ফাতরামি? তোকে কে বলছিল এত সকাল পর্যন্ত ঘুমাতে?"
"ডাক দিতা তাহলে।"
"এহ, খুব উঠতি ডাক দিলে।"
"আচ্ছা গেলাম।"
"ওই দাঁড়া...."
হাতে আমার একদম সময় নেই, সুতরাং দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম।
এম-আই ব্যান্ডে সময় এখন দশটা বেজে চল্লিশ মিনিট। এগারোটায় ভার্সিটির বাস আছে, বাস আমার এলাকা দিয়েই যায়, মানে মেইন রোড হয়ে যায় আরকি। আমার বাসা থেকে মেইন রোড পর্যন্ত হেঁটে যেতে সর্বোচ্চ দশ মিনিট লাগে। এগারোটার বাসে উঠলে ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ সাড়ে বারোটা বাজবে। মানে আধা ঘন্টা লেট। ব্যাপার না, এটেন্ডেন্স পেলেই হবে। ক্লাসে লেকচার শুনতে আমার একটু ও ভালো লাগে না, প্রতিটা ক্লাসেই আমি পিছনের বেঞ্চে বসি আর ফাইজলামি করি অথবা ঘুমাই।
দশটা তেপ্পান্ন বাজে, আমি মেইন রোডে দাঁড়ানো। কমপক্ষে সাত মিনিট বাকি বাস আসার, কি করা যায় সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে একটা সিগারেট কিনে ধরালাম, হেডফোনটা কানে লাগিয়ে গান ছাড়লাম। ধোঁয়া ছাড়ছি, গান শুনছি আর যানবাহন আসা-যাওয়া দেখছি। ব্যস্ত নগরী, যে যার স্বার্থে দৌড়াদৌড়ি করছে, কেউ অফিসে যাচ্ছে, কেউ যাচ্ছে নিজ নিজ শ্রেণী অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবার কেউ বা তাদেরকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে কিছু টাকার বিনিময়ে। এটাকে একটা চক্র হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে। একটা না, এখানে আসলে অনেকগুলো চক্র। এখানে আছে মানুষের রুটিনের চক্র, মানুষের জীবিকার চক্র, মানুষের.....
বাস চলে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি? সাতান্ন বাজে মাত্র।সিগারেটটা অর্ধেক বাকি এখনো, দ্রুত দুইটা টান দিয়ে ফেলে দিয়ে বাসের দিকে এগোলাম। বাসে বড় ভাইরা থাকতে পারেন, বিড়ি নিয়ে বাসে উঠলে একটু সমস্যা। বাসে উঠতে গিয়ে দেখি বাসের দরজায় ঝুলছে ফয়সাল। ফয়সাল আমার ডিপার্টমেন্টেরই ছোট ভাই।
"আসসালামু আলাইকুম ভাই।"
"ওয়ালাইকুম আসসালাম। কিরে, খবর কি?"
"আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপনাদের দোয়ায়, আপনি কেমন আছেন?
এই পোলাপান সর! ভাইরে বাসে উঠতে দে, সিট থেকে উঠ কেউ একজন, বইতে দে ভাইরে!"
"আছি কোন রকম।" বলে ওর কাঁধে আলতো করে একটা থাপ্পড় দিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। আর আমি উঠার সাথে সাথে বাস টান দিল। এ সময়ে বোধহয় এলাকা থেকে আর যাওয়ার মত কেউ নেই ও, শেষ বাস তো।
ওমা, একি। বাসে পরিচিত বড় ভাই কি, একটা ব্যাচমেট ও দেখি নাই, শুধু কিছু জুনিয়র আছে ডিপার্টমেন্টের। অবশ্য অন্য ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র/ব্যাচমেট থাকলে ও চেনার উপায় ও নেই। অবশ্য ওদের চিনে আমার কাজ কি? ওদের নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। আর বাসে বড় কোন নেতা থাকলে তো এমনিতেই চিনতাম।
বাসের ভিতরে ঢুকতেই কিছু পরিচিত/অপরিচিত পোলাপান সালাম দিয়ে বসার জায়গা করে দিল। পোলাপান বেশ ভালো, জানালার পাশে একটা জায়গা খালি করে দিয়েছে আমার জন্য, আমি ও সুন্দরমত বসে পড়লাম। মেজাজটা খারাপ লাগছে, দিনের বেলার প্রথম বিড়িটা শেষ না করে কেন যে ফেলে দিলাম! বাসটা কিন্তু একটু পরে আসলে ও তো পারতো। অথবা কিছুক্ষণের মধ্যে আরেকটা বাস থাকতো, ওটায় উঠতাম। এক সেকেন্ড, কেমন কথা ভাবলাম আমি এটা! নিজেরই হাসি পাচ্ছে। দশ মিনিট ব্যবধানে আমি একই রুটে একই ভার্সিটির দুটো বাস চাই! অবশ্য চাইতেই পারি, আমি আবার একটু উচ্চ বংশের সন্তান! যাই হোক, এগারোটার বাসই শেষ বাস এটা হল আসল কথা। এরপর ভার্সিটি যেতে হলে পাবলিক বাসে উঠা লাগত আর পাবলিক বাসে সিট পাওয়ার তো কোন সম্ভবনাই নেই, উল্টো ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে দাঁড়িয়ে থাকা লাগত। আর ভার্সিটির বাসে কি আরাম, জুনিয়ররা সিট ছেড়ে দেয়, আর আমি ও শান্তিতে বসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ক্যাম্পাসে যেতে পারি। রাস্তায় জ্যাম আছে। জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখলাম যে, যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত জ্যাম আর জ্যাম। আজকে বোধহয় ক্লাসটা মিস হয়ে গেল! বাস থেকে নেমে গিয়ে টংয়ে বসে থাকবো নাকি ভাবছি। এমন সময় দেখলাম একজন লোক সিগারেট বিক্রি করছে, দেরি না করে তাকে ডাক দিয়ে একটা সিগারেট কিনে ধরালাম। আমার আনন্দ আর দেখে কে, এরপর জুনিয়রগুলোরে ডাক দিলাম।
"কিরে, বাস নীরব কেন!"
"মানে বুঝলাম না ভাই।"
"গান ধরছিস না কেন তোরা!"
"সরি ভাই, এখনই ধরছি। কি গান ধরবো খালি বলেন।"
"জাদুকর ধর।"
পোলাপান গান ধরলো। আমি গান শুনছি, বিড়ি টানছি, রাস্তার দিকে আনমনে তাকিয়ে আছি। আশায় আছি, জ্যামটা ২-৪ মিনিট পর হয়তো ছুটবে। আশা করে লাভ নেই অবশ্য , সার্জেন্ট যখন সিগন্যাল ছাড়বেন তখনই বাস ছাড়বে। এজন্যই জীবনে আশা রাখতে নেই। যা হবার তা এমনিতেই হবে, আর যা হবে না তা কখনোই হবে না। আশার অপর নাম নিরাশা। ওদিকে কাকগুলো কা-কা করছে,
"কোনো এক ভোরে মুখোশের জাদুকর,
কোনো অবসরে চুপিচুপি বিষদাঁত, তারপর..."
                                                  [[অয়ন আল মামুন]]

জীবনমাল্য

লেখক ... .

No comments:

Post a Comment