নীল হিমুর অষ্ট প্রহর
প্রথম প্রহর
আজ শুক্রবার।
ঈদের চতুর্থ
দিন। দাঁড়িয়ে আছি মালিবাগ মোড়ের সিএনজি পাম্পে । আজ সারাদিন হিমুর মত হাঁটবো বলে বাসা
থেকে বেড়িয়েছি। গায়ে হলদে পাঞ্জাবীও আছে। সবে মাত্র সকাল ১০ টা বাজে। চিন্তা
করছি কোন দিকে যাবো। বেইলী রোড এ যাওয়া যায়। সেখানে প্রতিদিন ভিন্ন
নাটকের আবির্ভাব হয়। যারা নাটক লেখেন তাদের উচিত অন্য দেশের নাটক নকল না করে প্রতিদিন
একবার করে হলেও
বেইলী রোড ঘুরে যাওয়া। তাহলে এমনিতেই
নতুন কিছু বানিয়ে ফেলতে পারবেন তারা। যাই
হোক। একবার রুপাদের বাসায় গেলেও হয়। ওদের বাসার নিচে একটা চায়ের দোকান আছে। খুব ভাল
চা বানায়। সেখান থেকে এককাপ
চা খেয়ে রুপাদের
বাসায় ঢুকবো। দুই তালায় বাসা। লাফ দিলেই দরজা পাওয়া যায়। বাসায় যেহেতু যাচ্ছি সাথে
কিছু নিয়ে গেলে ভাল হয়। ওদের বাসার নিচেই গেন্ডারী বিক্রি হয়। মোটা দেখে একটা গেন্ডারী
নিলে কি রুপার বাসার লোকজন মাইন্ড করবে? করতে পারে। করলে করুক আমার সমস্যা নাই। কিন্তু সঙ্গে কোনো টাকা নেই। চা এর দোকানদার আমাকে চেনে বলে মাগনা খাওয়া যাবে। কিন্তু
বিশিষ্ট ইক্ষু বিক্রেতা আমাকে ইক্ষু দিবেন না। এগুলো ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম রুপাদের
বাসার নিচে। চায়ের দোকান কোনো কারণে বন্ধ। কিন্তু ইক্ষু বিক্রেতা আছেন। ইক্ষু বিক্রেতার
কাছে যদি বলি আমি রুপাদের বাসার কাজের লোক তাহলে
বাকিতে ইক্ষু পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।
চেহারার যে অবস্থা
কোনো সন্দেহই করবে না।
- ভাই, মোটা দেখে দুটা ইক্ষু দেন। চিনি
মিষ্টি না হইলে কিন্তু ইক্ষু ফেরত।
- আমান লইবেন নাকি পিস।
- অবশ্যি পিস হবে । ছোট ছোট পিস হবে। মালকিনের
হুকুম।
- কোন বাড়িতে ঢুকছেন?
- এই যে এই লাল বাড়িতে। নতুন এসেছি। কাজ
পার্মানেন্ট করি নাই। আগে মালিক পক্ষের হাবভাব দেখি। সুবিধার না হইলে ছেড়ে দেবো। আচ্ছা
ভাই আপনি তো শুনলাম এদের চেনেন। এরা মানুষ কেমন?
- ভাই, কোনো টেনশন নিয়েন না। এরা মানুষ
বড় ভালা। আপনে চাকরি পার্মানেন্ট এর ব্যবস্থা করেন।
- জ্বী আচ্ছা। শুকরিয়া।
ইক্ষু বিক্রেতার কাছে
বেশ সুবিধা পাওয়া গেল। নিজে থেকেই কার্য
সমাধা করেছে। এমনকি ইক্ষুর দামও চায় নি।
সম্ভবত বাড়িওয়ালার কাছ থেকে নেবে বলে। যাহাই হোক আমি ইক্ষু নিয়ে রুপাদের বাসার দরজার
সামনে গেলাম। দরজায় দুইবার নক করতেই দরজা খুলে গেল। যেন আমার জন্যে দরজায় অপেক্ষার
পালা হচ্ছিল। দরজা খুলে সিদ্দিক আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “আসেন হিমু ভাই। পার্টি তো অনেক
আগেই শুরু হইছে । আপনে এত লেট কেন? হাতে এগুলান আবার কি আনছেন? গেন্ডারী নাকি?”
আমার হাতের
ইক্ষু গুলো ছোঁ দিয়ে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল সিদ্দিক। বুঝলাম বাসায় পরিবারের
কেউ নাই। সম্ভবত রুপার বান্ধবীরা এসেছে। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। হয়তো কোনো পারিবারিক
অনুষ্ঠান। আস্তে আস্তে গেলাম কথিত পার্টি রুমের দিকে। দরজা একটু খোলা। তাকাতেই দেখি
কতিপয় যুবক
যুবতীর উন্মত্তা। রুপাকেও দেখলাম
তাদের মাঝে। রাজ নামক একজনের সাথে তিনি
খুব
নিকটবর্তী।
আমি নিশ্চুপ, বেরিয়ে গেলাম বাসা
থেকে। নিচে
আবার দেখা হল ইক্ষু
বিক্রেতার সাথে।
আমাকে দেখে একগাল হাসলো। আমি সেই হাসির উত্তর না দিয়েই দ্রুত পায়ে হাঁক্ষটা শুরু করলাম। অনির্দিষ্টের প্রতি সে যাত্রা।
হঠাৎ বাতাসে কণ্ঠস্বর, “ হে পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছো?”
হিমুদের আকর্ষণ থাকতে নেই। হিমুরা পথ হারায়
না। আমি হিমু হয়ে ঘুরতে থাকলাম ধুলোর নগরে।
দ্বিতীয় প্রহর
সকাল থেকে বৃষ্টি
হচ্ছে।
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আমি বসে আছি রমনায়। মোজাইক করা বেঞ্চ। ভিজে স্যঁতস্যাতে হয়ে
গেছে। শুয়ে পরতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ভেজা বেঞ্চে শুতে মন চাইছে না। হিমুরা সবসময় স্বাভাবিকের
উল্টাটা করে।নবীন হিমু হিসেবে আমার উচিত ভেজা আর কাদায় মাখা
রাস্তায় শুয়ে আকাশ মুখি হয়ে বৃষ্টিবিলাস করা। অনেকক্ষণ ধরে রমনায় আছি কিন্তু লোকজনের সমাগম খুব একটা নেই। মাটিতে শুয়ে থাকা নীল হিমু কে
কেউই দেখবে না হয়তো।
বেঞ্চের পাশেই কাদাটে রাস্তা। আমি বেঞ্চ থেকে নেমে বসেছি। চোখ বন্ধ। এখন শুইয়ে
পরবো। নিথর হয়ে হয়ে পরে থাকবো। এমন সময় কে যেন আমাকে ডাক দিল। “হিমু ভাই...” আমি চোখ
খুলে তাকিয়ে দেখি রুপাদের বাসার নিচের ইক্ষু বিক্রেতা। তার নাম মনে নাই। জোর পায়ে সে
আমার দিকে আসছে। তার মুখ এক প্রস্থ হাসিতে অলংকৃত। যেন সে আমাকেই খুঁজতে বেরিয়েছিল। বিজয়ের
সেই হাসি নিয়ে সে আমার দিকে ধেয়ে আসছে।
- হিমু ভাই। আপনে এখানে?
- হুম
- এই বর্ষার মাঝে এইখানে এমনে বইসা আছেন কেন?
- বসে নেই। শুয়ে পরছিলাম। তখনই আপনি ডাক দিলেন।
- গোস্তাকি মাফ করবেন হিমু ভাই। বুঝতে পারি নাই।
তা এইখানে এমনে শুইয়া কি করবেন?
- মাটি হল মা। আমি মায়ের কোলে শুয়ে বৃষ্টি দেখবো।
- হিমু ভাই, ফায়দা কি?
- ফায়দা কিছুই নাই। আপনি যে মানুষ তাতে ফায়দা কি?
- সত্য বলেছেন। কঠিন সত্য। আমি কি আপনার সাথে শুইতে পারি?
- অবশ্যি পারেন। মাটি তো শুধু আমার মা না।
- আফসোস! আপনের মত কেউ বুজে না। সবার
এক ধান্দা। কেডা কার আগে যাইবো। কিয়ামত সন্নিকট। আপনে কি বলেন হিমু ভাই?
- হুম! সন্নিকটে।
আমি আর ইক্ষু বিক্রেতা ইদ্রিস মাটিতে শুয়ে আছি। বৃষ্টি আমাদের দেহ ভিজিয়ে দিচ্ছে
পরম মমতায়। মাটিরূপ মাতা আমাদের পরম স্নেহে আগলে রেখেছে। জন্ম মাটিতে, জীবন মাটিতে, মৃত্যুও মাটিতে। ভেবেছিলাম রমনায় কেউ নাই। কালো কাক ছাড়া আমাদের কেউ দেখবে না। কিন্তু আমার ধারণা
ভুল। ১৫-২০ জন টোকাই টাইপ পোলাপান আমাদের ঘিরে ঘুরঘুর করছে। তাদের চোখে নির্লিপ্ত প্রশ্ন।
তাদের মধ্যে সরদার গোছের একজন আমার মাথার কাছে এসে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলো আমরা কারা।আমি উত্তরে শুধু ইদ্রিসের দিকে
তাকালাম। টোকাই সরদার বুঝে গেল যে আমাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। তাই সে ইদ্রিসের কাছে
গেল। ইদ্রিস ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম থেকে উঠে টোকাই দল দেখে প্রথমে একটু ভয় পেয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি প্রশ্রয়ের
হাসি হাসলাম।
ইদ্রিস আর টোকাই
সরদার বিশাল বটবৃক্ষের আড়ালে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর তারা হাসি মুখে ফিরল। আমার কাছে
টোকাই সরদার এসেই সালাম দিল। উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে চলে গেল তার দলের কাছে।
- হিমু ভাই।
- বল ইদ্রিস।
- কাম ফাইনাল। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
- কিসের কাজ?
- আপনে শুধু দেখেন। এই ইদ্রিস কি করে।
- হুম।
টোকাই সরদার একটা
তেহারির প্যাকেট নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে বলল, “মাটি বাপ,
অধমের হাদিয়া নেন” আমি ইদ্রিসে রদিকে তাকালাম। সে হাসছে। আমি হাদিয়া
গ্রহণ করলাম।
তৃতীয় প্রহর
অন্ধকার ঘর।
বেড়ার ফাঁক দিয়ে
সামান্য আলো আসছে। আমি খাটে শুয়ে আছি। বাইরে কিছু একটা নিয়ে গণ্ডগোল হচ্ছে। কুৎসিত
গালি শোনা যাচ্ছে। আমি নির্বিকার ভাবে শুয়ে আছি। মুখের উপর একটা মাছি ভনভন করে ঘুরছে।
নীল রঙের পেট মোটা মাছি হবার সম্ভাবনা। আলো নেই বলে দেখতে পারছি না। ইচ্ছে করলেই আলো
জ্বালাতে পারি। হাতের কাছেই একটা সুইচ আছে। আবার নার্গিস কে বললেও হয়। সে দরজার ওপাশেই
আছে। ইদ্রিস তাকে বলেছে আমার সার্বক্ষণিক সেবা করতে।
হঠাৎ লাইট জ্বালানো হলো। আকস্মিক তীব্র আলোকচ্ছটা সহ্য হল না আমার। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ইদ্রিস কানের
কাছে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলো। বোঝা যাচ্ছিলো সে ভাল খবর দিতে এসেছে। তার কথায় একটা
খুশির আমেজ আছে।
- হিমু ভাই সংবাদ
শুভ।
- কেন? তোমার পুত্র
সন্তান হয়েছে?
- কি যে বলেন না
হিমু ভাই। আমি তো এখনতরি নিকা করি নাই।
- অ ।
- হিমু ভাই...
- হু।
- ঘটনা হইলো গিয়া,
আপনেরে টিবিত(টেলিভিশনে) দেখাইতেছে।
- অ
- দুপুরের পরের ঘটনা
সারা দেশে ছড়াইয়া গেছে। হিমু ভাই, আমাদের আর পেছন ফিরা তাকাইতে হইবো না।
- অ
- আরে বুঝলেন না
হিমু ভাই। আপনে পিরাতি পাইছেন। বইকালে রমনায় যা খেল দেখাইলেন। এখন খালি সময়ের অপেক্ষা
। দূর দ্যাশ থেইকা মানুষ আসবে।
- তুমি খুশি?
- খুশি না মানে?
বড়লোক হইতে আর মাত্র তিন হাত বাকি। এই যে দেখেন, এক দুই এই তিন। এইখানে ধনসম্পদ।
ইদ্রিস অঙ্গভঙ্গি
করে দেখায় টাকা পয়সা মাত্র তিন হাত দূরে। ইতোমধ্যে ঘরে টিভি এসে গেছে সেটিং চলছে। আমাকে
আমার প্রতিচ্ছবি দেখাতেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু সম্ভবত কোনো সমস্যা হয়েছে। টিভি চলছে
না। ইদ্রিস টিভি ওয়ালা ছোকরা কে সমানে বকে যাচ্ছে।
অনেক ঝক্কিঝামেলার
পর টিভি চালু হল। টিভিতে হিমুকে দেখা গেল। সে টোকাই সরদারকে শূন্যে ভাসিয়ে ফেলেছে।
“পদার্থবিদরা বিচি কলা খান” এরকম অবস্থা।
- ইদ্রিস টিভি বন্ধ
কর।
- জ্বি আচ্ছা।
মুখ কালো করে সে
টিভি বন্ধ করে দিল। এরকম সময় টোকাই সরদার হাজির। সে যে খুব খুশি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
খুশি হওয়ার মতই ঘটনা।
হাজার মানুষের সামনে শূন্যে ভাসা, শত কণ্ঠের বাহবা। আর কি চাই? তার উপর আবার টিভিতে
দেখিয়েছে পুরোটা।
- মাটি পিতা।
- হু?
- একজন মেয়েছেলে
আপনার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছে। সে মেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
- অ।
- উনি বলেছে সাক্ষাত
নাকি অতীব জরুরী। তার গায়ে ছিল নীল শাড়ী। সাদা পাড়। আচলে হাতের কাজ ছিল। হাতের কাজ
দেখার মত হয়েছে।
- তার ব্লাউজের রঙ
কি?
এরকম প্রশ্নে বেচারা
চুপসে গেছে। আমি বাইরের দিকে হাটা ধরলাম। সম্ভবত রুপা এসেছে।
বস্তি থেকে মেইন
রাস্তায় যেতে একটা গলিতে দুবার মোড় ঘুরতে হয়। আমি দ্বিতীয় মোড়ে গর্তে পরে গেলাম। পায়ে
প্রচণ্ড ব্যথা করছে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে মচকে গেছে। টোকাই সরদার আমাকে কোনোমতে ধরে
বস্তির ভেতর নিয়ে এসেছে।
আমি খাটে শুয়ে আছি।
নার্গিস পায়ে গরম তেল মালিশ করছে। বুঝতে পারছি, এ ব্যথা বেশ কিছুদিন আমাকে ভোগাবে।
ওই দিকে বড় রাস্তায় রুপা দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। ঘণ্টার হিসেবে কম করে হলেও সাড়ে তিন ঘণ্টা। সে আমার উপর রাগ করে চলে গেছে। ভেবেছে আমি ইচ্ছে করেই তার সাথে
দেখা করিনি।
মাঝে মাঝে মন খারাপ
করা, রাগ করা ভাল। কিন্তু আফসোস একটাই, সে জানতে পারলো না যে তার কাছে ছুটে যেতে গিয়েই
আহত হয়েছে মাটি পিতা নীল হিমু।
ব্যাপার । হিমুদের যেমন পিছু টান থাকতে নেই তেমনি আফসোসও
থাকতে নেই। হিমুরা গাধামানব না হিমুরা হচ্ছে মহামানব।
[[2014October25Dhaka2112KING.afk]]
চতুর্থ প্রহর
[চতুর্থ পর্ব]
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে।
সবে সন্ধ্যা নেমেছে। ঢাকা শহরের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা-রাত এরকম কোনো ব্যাপার নেই। শুধু দিন বা রাত। তাই সন্ধ্যা নামার সৌন্দর্য দেখা যায় না। ভোরের আলো আর সন্ধ্যার আঁধার মানুষের মনের ভেতর একটা আলাদা প্রভাব ফেলে। আর এই শহরের মানুষ এই দুই জিনিস থেকেই বঞ্চিত । সম্ভবত এই জন্যেই মানুষগুলো খুব বেশি একগুঁয়ে। মনের ভেতর আবেগ নাই। ভালোবাসাও নাই।
আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি এক বিলাসবহুল হোটেল এর সামনে। ইচ্ছা ছিল ভেতরে যাব। কিন্তু দারোয়ান দিচ্ছে না। না দেয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল। সে নীরব। ঢুকতে না দেয়ার একটা কারণ হতে পারে আমার বেশভূষা। অত্যন্ত জঘন্য। নীল পাঞ্জাবী প্রায় কালচে হয়ে গেছে। আর দুর্গন্ধে কথা না হয় বাদই দিলাম। গত তিন দিন রাস্তায় নিশিযাপন করেছি। একদিন রমনায়। একদিন ছিলাম জয়দেবপুর জংশনে। কাল ছিলাম বুড়িগঙ্গায়। বুড়িগঙ্গার নিশিবাস ছিল সবচেয়ে স্মরণীয়।
আমি আবার গেটের সামনে গেলাম –
সবে সন্ধ্যা নেমেছে। ঢাকা শহরের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা-রাত এরকম কোনো ব্যাপার নেই। শুধু দিন বা রাত। তাই সন্ধ্যা নামার সৌন্দর্য দেখা যায় না। ভোরের আলো আর সন্ধ্যার আঁধার মানুষের মনের ভেতর একটা আলাদা প্রভাব ফেলে। আর এই শহরের মানুষ এই দুই জিনিস থেকেই বঞ্চিত । সম্ভবত এই জন্যেই মানুষগুলো খুব বেশি একগুঁয়ে। মনের ভেতর আবেগ নাই। ভালোবাসাও নাই।
আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি এক বিলাসবহুল হোটেল এর সামনে। ইচ্ছা ছিল ভেতরে যাব। কিন্তু দারোয়ান দিচ্ছে না। না দেয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল। সে নীরব। ঢুকতে না দেয়ার একটা কারণ হতে পারে আমার বেশভূষা। অত্যন্ত জঘন্য। নীল পাঞ্জাবী প্রায় কালচে হয়ে গেছে। আর দুর্গন্ধে কথা না হয় বাদই দিলাম। গত তিন দিন রাস্তায় নিশিযাপন করেছি। একদিন রমনায়। একদিন ছিলাম জয়দেবপুর জংশনে। কাল ছিলাম বুড়িগঙ্গায়। বুড়িগঙ্গার নিশিবাস ছিল সবচেয়ে স্মরণীয়।
আমি আবার গেটের সামনে গেলাম –
— ভাই সাহেব। একবার শুধু ঢুকতে দেন। ভেতরে জরুরী মিটিং আছে। আমি বিনা মিটিং শুরু হবে না।
— আপনাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া যাবে না। আপনি চলে যান।
— কেন জনাব। সমস্যা কি?
— আরে ভাই, জ্বালাইয়েন না তো। আপনেরে এই সুরতে ঢুকতে দিলে আমার চাকরি থাকব না। বাসায় তিন তিন টা মেয়ে। বড় জনের বিবাহের বয়স হয়েছে।
— ভাই। আপনি বুঝতে পারতেছেন না। ভেতরে আমার জরুরি মিটিং আছে।
আমাকে একবার ঢুকতে দেন আমি আপনার মেয়ের বিবাহের ব্যবস্থা করে দিব।
সে একবার আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। আমার কথা বিশ্বাস করার কোন কারণ নাই। সে বিশ্বাস ও করে নাই অবশ্যি। কিন্তু আমার ব্যঙ্কে যে পরিমান টাকা আছে তা দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় কয়েক হাজার বিয়ে এই হোটেলে করিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আগে দর্শনদারি তারপর ব্যাকগ্রাউন্ড বিচারী।
আমি গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আমি ফোন ব্যবহার করি না। অরি বিরক্তিকর জিনিস। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই বস্তু কাছে থাকলেই ভালো হত। আশেপাশের কারো কাছ থেকে ফোন নিয়ে কথা বলা যায়। কিন্তু কেউ আমাকে কথা বলার জন্য ফোন দেবে এরকম কোনো সম্ভাবনা নাই। পকেটে ছেঁড়া দুইটা দুটাকার নোট আছে। একটার অবস্থা অত্যধিক খারাপ। দোকান থেকে ফোন করার উদ্দেশ্যে আমি রওনা দিলাম।
আশেপাশে তেমন কোনো দোকান পাট নাই। রাস্তাটা সুন্দর। আমি ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম। কিছুক্ষণ পর পর ট্রাক যাচ্ছে। আশেপাশে মানুষজনও খুব বেশি নাই। ঢাকা শহর সাড়ে ১০ টা নাগাদ এমন জনহীন হয়ে পড়বে ভাবা যায় না। কালকে হরতাল টরতাল নাকি কে জানে। হরতালের আগের দিন রাতে গাড়ি পোড়ানো হয় বেশি। কেউ বের হতে চায় না। আজ কি সেরকম কোনো দিন?
রাস্তার এই অংশে আলো খুব বেশি না। আলো আঁধারী। আমার পাশ দিয়ে একটা সাইকেল ক্রিং ক্রিং করতে করতে যাচ্ছে। চলছেও খুব আস্তে। ফাকা রাস্তায় আস্তে চালানোরও কারণ নাই আবার ক্রিং ক্রিং করারও কারণ নাই। লোকটার মাথায় বোধয় ছিট আছে। কাঁধে একটা ব্যাগের মত ঝোলানো। ব্যাগের দিকে তার নজর চোখে পড়ার মত। আমার থেকে একটু সামনে চলে গেছে সাইকেল ওয়ালা।
হঠাৎ করে ধুপ করে সাইকেল ওয়ালা পরে গেল। সাইকেলের সামনের খুলে গেছে। চাকাটা ঘুরতে ঘুরতে এসে তার উপরই পরলো। বেপারটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু আমার তীব্র হাসি পাচ্ছে। এখন আস্তে হাসলেও শোনা যাওয়ার কথা। আমি অনেক কষ্টে হাসি থামানোর চেষ্টা করছি। পেছন থেকে হঠাৎ স্বজোরে হর্ণ দিতে দিতে এগিয়ে আসছে একটা ট্রাক। তীব্র আতঙ্ক কাজ করছিলো আমার মনে। হিমুদের ভয় পেতে নাই। কিন্তু আমি তীব্র ভয় পাচ্ছি। হঠাৎ দেখি আমার বাম পায়ের নিচে মাটি নাই। ঢাকনা ছাড়া ম্যানহোলের মধ্যে বাম পা ঢুকে গেছে।
আরে, আমি এখন কি করবো? পেছনে ধেয়ে আসছে ট্রাক। তীব্র হর্ণ। মিসির আলি সাহেব এরকম অবস্থায় থাকলে কি করতেন? যুক্তি দিয়ে বের করতেন যে আমার কোনো ক্ষতি নাই। আমি রাস্তার পাশে উচু ফুটপাতে। ট্রাক ফুটপাতে উঠবে না।
আসলেই মানুষ হাস্যকর চিড়িয়া। পৃথিবীর সব থেকে বুদ্ধিমান অথচ অত্যাধিক ভীতু। আমি ম্যনহোল থেকে পা বের করতে ব্যস্ত। হঠাৎ করেই কানে ভেসে আসলো আর্তনাদের চিৎকার। আমি তাকিয়ে দেখি সাইকেল ওয়ালার মাথার খুলি গুড়া করে দিয়ে গেছে ট্রাকটা। রক্তাক্ত চারিপাশ। ঘিলু ছিটকে পড়েছে চতুর্দিকে। আমি হঠাৎ কেমন জানি ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। বিপদের মাত্রা এতটাই বেশি যে ম্যনহোল থেকে পা একা একাই বের হয়ে এসেছে।
ছোকড়া মতন একটা ছেলে কোত্থেকে উড়ে এসে সাইকেল ওয়ালার পা থেকে জুতা জোড়া খুলে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আকস্মিক ঘটনায় আমি স্থবির।
পাশে দিয়ে পর পর দুইটা রিকশা যাচ্ছে। প্রথম রিকশার যাত্রী ভদ্রলোক এক্সিডেন্ট স্পট দেখে রিকশাওয়ালা কে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, “ অই মিয়া তাড়াতাড়ি টানেন। পুলিশ আসলে হুদাই প্যারা। ”
পেছনের রিকশায় দুজন লোক। একজন সামনের রিকশার লোকটিকে উদ্দেশ্য করে গালি দিল। তার কথার মোরাল হচ্ছে মানুষ মানুষের জন্যে । তারা রিকশা থেকে দ্রুত নেমে রেস্কিউ মিশন শুরু করে দিয়েছে।
মোটা লোকটার দৌড়া দৌড়ি দেখার মত। তার প্রতি কেন জানি শ্রদ্ধাবোধ জন্মালো। হঠাৎ সে সাইকেলওয়ালার ব্যাগ খুলে ভেতরে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তাকে এখন খুব নার্ভাস লাগছে। নড়াচড়াও করছে সাবধানে। এদিকে লম্বাজন সাইকেলওয়ালার পকেট থেকে মোবাইল বের করে এনেছে। মোটা লোকটা লম্বাজনকে ডেকে কি যেন বললো। এখন দুইজনই নার্ভাস। তাদের ফিসফিসানিতে শুধু একটা শব্দই শুনতে পেলাম, “টাকা” ।
লম্বাজন সাইকেলওয়ালার মোবাইল ফোনটা পাশে ফেলে দিল এবং টাকার ব্যগটা নিয়ে রিকশায় করে দ্রুত চলে গেল। মানুষ এখন আর মানুষের জন্য না। মানুষ এখন টাকার জন্য। সবার উপরে টাকা সত্য তাহার উপরে নাই অবস্থা।
আমি ততক্ষণে ডেডবডির কাছে চলে এসেছি। মোবাইল ফোনটা তুলে হাতে নিলাম। সাথে সাথেই বেজে ওঠা শুরু করলো। কন্টাক্ট নাম্বার “অরু” নামে সেভ করা। একটা ৩-৪ মাস বয়েসের বাচ্চার ছবি পুরা স্ক্রিন জুড়ে।
রাত প্রায় পৌনে বারোটা। সম্ভবত অরু তার স্ত্রীর নাম। অনেক রাত হয়েছে। ছোট বাচ্চা নিয়ে একা একা ভয় পাচ্ছে। স্বামীকে ফোন করেছে কিছু সাহস সঞ্চয়ের প্রত্যাশায় আর দ্রুত বাসায় ফেরার তাগাদা দিতে। সে মা জানে না যে খোকার বাবা আর কোনদিন, কোনোদিনই ফিরবে না ।
কে যেন হঠাৎ করে আমার খুব খুব খারাপ লাগা শুরু করলো। চোখ ছলছল করছে কিনা কে জানে।
হিমুদের কোনো মায়া থাকতে নেই। হিমুরা সকল আবেগের ঊর্ধ্বে। কিন্তু আমি কান্না থামাতে পারছি না। আচ্ছা, আমি কি হিমু হতে পারবই না?
[[কিংশুক২০১৫নভেম্বার১৯শান্তিবাগ,ঢাকা০১২১]]
পঞ্চম প্রহর
আজ ঈদ। ঈদুল ফিতর।
সকাল থেকে ভারি বর্ষণ হচ্ছে। রোজার ঈদের সন থেকে
প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে ঘুরাঘুরি। কিন্তু
বৃষ্টির জন্য বের
হতে পারছে না কেউ। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে তরুণ-তরুণীদের। বছরের এইরকম বিশেষ কয়েকটি
দিনেই তারা বিশেষ সাক্ষাৎ করে থাকে। কিন্তু তার মধ্যে একটা দিন বাদ পড়লে ব্যপারটা খারাপই হয়।
মাঝে মাঝে প্রকৃতির
লীলা খেলা আমার মনে বিস্ময় সঞ্চার করে। যেই বৃষ্টি রোমান্টিকতার চরম মুহূর্ত উপহার
দিতে পারে, যেই বৃষ্টি কবির মনে উথাল পাথাল সৃষ্টি করে, সেই একই বৃষ্টি অনেক সময় প্রেমের ঘোর বিরুদ্ধচারী।
আমি হিমু। ঠিক হিমু নই। হিমু হওয়ার প্রচেষ্টায়
আছি। সরাসরি হিমুর সব কিছু হুবহু ফলো করি তেমন না। মোটামুটি মডিফাইড হিমু বলা যায়।
তবে হিমুর মত আমারও রুপা আছে। কিন্তু হিমু ফোন
নামক যন্ত্র খুব একটা পছন্দ করে না কিন্তু আমি নিয়মিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। আবার
আরেকটা বিশেষ অমিল হচ্ছে আমি নীল পাঞ্জাবী পড়ি কিন্তু হিমু পড়তো গাউছিয়া থেকে কেনা
হলুদ পাঞ্জাবী। যাই হোক আমি মডিফাইড হিমু হিসেবে বেশ আরামেই আছি। তবে সম্ভবত হিমুর
রুপা হিমুর সমস্যাগুলো ধরতে পারতো কিন্তু আমার রুপা তা পারে না। সে আমাকে আট-দশ জন
‘সুস্থ’ মানুষ হিসেবেই চায়। তবে আমি হিমু
না হতে পারি কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ নই। মাথায় যথেষ্ট সমস্যা আছে।
যাই হোক। যারা আমাকে অর্থাৎ নীল হিমু কে আগে থেকে
চেনেন তাদের জন্য সামান্য কিছু কথা বললাম আরকি। অনেক টা FAQ এর মত।
এখন আজকের দিনের কথায় আসা যাক।
রুপা আমাকে বলেছিল
আজ দেখা করবে। আমিও খুশি মনে আমার নীল পাঞ্জাবী বের করে ইস্ত্রি করা শুরু করলাম। রুপা
আমাকে যেসমস্ত জায়গায় নিয়ে যায় সেখানে আইরন করা জামা
না পরে গেলে অনেকেই বিরূপ দৃষ্টি দেয়। একদিন তো আমাকে প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে
দিতে নিয়েছিল। আমি যখন ধাক্কা খেয়ে এক গাল হাসি সমেত বের হচ্ছি তখন রুপা এসে আমাকে
উদ্ধার করেছে।
ইস্ত্রি করা নীল
পাঞ্জাবী গায়ে জড়িয়েই আমি রুপা কে ফোন
দিলাম। সে ফোন ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো তার চোখের কাজল হারিয়ে গেছে। ঈদ উপলক্ষে দামী
ব্রান্ড এর কাজল কিনেছিল সে। আমি বললাম পুরনো কাজল দিতে। এ কথা শুনে সে সম্ভবত খানিকটা
আহত হল। সে ভেবে বসলো আমি তাকে অপমান করার জন্য এধরনের কথা বলেছি। আমি আমার পুরনো নীল
পাঞ্জাবী পড়ে ঈদের দিন যদি বের হতে পারি তবে সামান্য কাজল কেনো সে পুরনো টাই ব্যবহার
করতে পারবে না ভেবে পেলাম না। সে রীতিমত ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে দিল। আমি এক পর্যায়ে
বলেই বসলাম এসব অহেতুক ফালতু প্যাঁচাল শুনতে ভালো লাগতেছে না। সে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত
কণ্ঠে বাই বলেই রেখে দিল।
তারপর মোটামুটি অর্ধশত কল তাকে করেছি কিন্তু সে
ধরছে না। সে বালিশ চেপে কাঁদছে এই ব্যপারটা পরিষ্কার। আমি এখন নিরুপায়।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আমি নীল পাঞ্জাবী গায়ে
নগ্ন পায়ে ঢাকার রাজপথে হাঁটছি। শাহবাগে যাব। কিছু টকটকে লাল ফুল কিনতে হবে কিন্তু
লাল ফুলের নাম মনে পরছে না। সম্ভবত গোলাপ ছাড়া আর কোনো ফুলের রঙ লাল হয় না। ঈদের দিনে
শাহবাগের ফুলের দোকান খোলা পাবো কিনা কে জানে। শাহবাগের ফুলের দোকানিরা মানুষের বিশেষ
দিন গুলো তে সাহায্য করে। আজকে ঈদ। একটা বিশেষ দিন। সে হিসেবে দোকান খোলা। আবার উলটা
যুক্তিও গ্রহণযোগ্য। সারাবছর সর্বসাধারণের বিশেষ দিন আরো বিশেষ করতে করতেই কেটে যায়
তাদের। তাদেরও অধিকার আছে এক দু দিন নিজের বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকার। একটা কাজই করা যায়,
শাহবাগে গিয়ে নিজে দেখা। দু একজনের ফোন নাম্বার নিয়ে আসা দরকার। মানুষের কোন কিছুর
চাহিদা একবার হলে তা আর থামে না। ব্যাপক সম্ভাবনা যে আমার এর পর থেকে প্রায়শই ফুল কেনা
লাগবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারা আমাকে ফোন নাম্বার দেবেন কিনা।
আরে লাল ফুলের নাম মনে পড়েছে। কৃষ্ণচূড়া, পলাশ,
শিমুল, জবা... একবার কোনো কিছু মনে পড়লে একের পর এক মনে পড়তেই থাকে।
দুপুর ১ টার মত বাজে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি রুপার বাসার সামনে। আমার হাতে
হরেক রকম লাল ফুলের বিশাল তোরা। ফুলের তোরা না বলে ফুলের ঝোপঝাড় বলাই শ্রেয়। রুপা কে
আমি ফোন করেই যাচ্ছি। সে ধরছে না। বৃষ্টি থেকে এখন খটখটে রোদ উঠেছে। আমি রোদের তাপে
দাহ হচ্ছি আর অপেক্ষা করছি। আমার সাথে তাপদাহ ভোগ করছে আমার হাতের ফুলের ঝোপঝাড়, সেও
বোধ করি অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমরা কেউই জানি না এই তিতিক্ষার ইতি কোথায়।
[এই খানে গল্পটা শেষ না। কিন্তু আমার মৃত্যু ভয়ে
বাকি অংশ লিখতে পারছি না। যারা বিগতে আমার সাথে থেকেছেন তারা খানিকটা আন্দাজ করেতে
পারছেন বলে আমার বিশ্বাস।]
মানুষ অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে এমন কিছুর জন্য
যার কোন সীমানা নাই। অসীমের প্রতিই মানুষের আগ্রহ।
[[কিংশুক২০১৫জুলাই১৮সিরাজগঞ্জ১৩২৭]]
ষষ্ঠ প্রহর
আজ পূর্ণিমা রাত।
ইচ্ছা আছে ঘরে বসে জোছনা বিলাস করবো।
আমার খাটের পাশেই
জানালা। বিশাল জানালায় না আছে কোনো পাল্লা না আছে গ্রিল। বাতাস বৃষ্টি জোছনা রোদ আর
চোর নির্দ্বিধায় আমার ঘরে ঢুকে পরতে পারে।
বেপারটা আমার ভালোই লাগে। ইচ্ছে ছিলো খাটে শুয়ে নিরিবিলি
জ্যোৎস্না দেখবো। কিন্তু আমার পাশের ঘরে সিয়াম নামের একটা ছেলে থাকে। সে আমার ঘরের
নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়েছে। ক্যাসেট প্লেয়ার বা এ ধরনের কোনো যন্ত্রে সশব্দে গান বাজাচ্ছে।
"অন্ধকার ঘরে, কাগজের টুকরো ছিঁড়ে, কেটে যায়
আমার সময়..."
গান টা এমনি সময়ে অসাধারণ। কিন্তু বর্তমানে তা
আমার নিকট অত্যধিক বিরক্তির কারণ। আমার জোছনা বিলাস সফল হচ্ছে না। মনোযোগ চলে যাচ্ছে
গানের দিকে। উঠে গিয়ে বললেই গান বন্ধ করে দেবে। কিন্তু এই সময় উঠতে ইচ্ছে করছে না।
হঠাৎ গান থেমে গেলো। আমি খুশি হলাম। কিন্তু সুখ
আমার কপালে সয় না। দরজায় খট খট শব্দ। ওপাশে সিয়াম।
"হিমুদা, ও হিমুদা... ঘুমিয়ে গেছো? দরজাটা
খোলো..."
আমি তাকে দরজা ঠেলে ভেতরে আসতে বললাম। সে নিখুঁত
ভাবে কোন প্রকার শব্দ ছাড়াই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। এবং আগের মত শব্দহীনভাবে দরজা লাগিয়ে
দিল।
- হিমুদা, কেমন আছো?
- ভালো নাই।
- কেন? আমি জোরে গান বাজিয়েছি বলে তুমি রাগ করনি
তো?
- ভালো না থাকার কারণ ধরতে পেরেছিস।
ছেলেটা চুপসে গেলো।
রাজ্যের আঁধার তার সুন্দর গোল মুখে ভর করেছে।
তার প্রতি আমার রাগ ক্রমশই মায়ায় পরিণত হচ্ছে।
- কি বলতে এসেছিস বলে ফেল। আমি ভালোই আছি। এমনি
মজা করেছি তোর সাথে।
- সত্যি? আমি যা ভয় পেয়েছিলাম বাবা। এখন শান্তি
পেলাম।
-কি বলতে এসেছিস, বলে ফেল।
-ও হ্যাঁ। আমি এই মোবাইল ফোন টা আজকে কিনলাম। খাস
চাইনিজ ফোন। এতক্ষণ অর্ধেক ভলিউমে গান বাজাচ্ছিলাম। এই যে দেখো।
বিশাল একটা ফোন। আমার ফোনের প্রায় চার গুন বড় হবে।
আমি নেড়েচেড়ে দেখছি। আর ও সদ্য কেনা ফোনের বৃত্তান্ত বর্ণনা করছে।
আমি মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকা পালন করছি। শুনতে ভালোও
লাগছে না আবার খারাপও লাগছে না। আমি শুধু হু হা করে যাচ্ছি।
এমন সময় আবার কে
যেন দরজায় কড়া নাড়লো। আমি ভ্রু কুচকে দরজার দিকে তাকালাম। কে হতে পারে সেটা ধারণা করার চেষ্টা করছি। সিয়ামও দরজার দিকে তাকালো। তার বক্তৃতায় ছেদ পরেছে। সে আমার মুখের
দিকে তাকিয়ে বলল," খুলবো?" আমি বললাম দরজা খোলাই আছে। উঠে যেয়ে খুলতে হবে
না।
আগন্তুক পরিচয় কি হতে পারে মাথায় আসছে না। রুপা নয় তো? এত
রাতে তার আসার সম্ভাবনা কতটুকু? এই অসময়ে তার আসার কারণ কি হতে পারে? সে কি একা এসেছে?
আগন্তুক অনুমতি ব্যতীত দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ
করলো। সিয়াম যতটুকু নিঃশব্দে দরজা খুলেছে সে
ততটুকুই সশব্দে দরজা খুলেছে।
আগন্তুক আমার সু পরিচিত। টোকাই সরদার। আমার দিকে
তাকিয়ে সব গুলো দাঁত বের করে হাসছে।
- কি রে, জেল থেকে ছাড়া পেলি কবে? *
- আইজ বৈকালে।
- তুই একাই এসেছিস? নাকি ইদ্রিসও এসেছে?
- উনারে তেনারা ছাড়ে নাই।
- কেন?
- উনি নাকি স্বপ্ন দেখছে, আফনে তার মাথায় ঠ্যং
(পা) ছুয়াইয়া আশিব্বাদ (আশীর্বাদ) করবেন তারপর তারে ছাড়াইয়া আনবেন।
- ও আচ্ছা।
টোকাই সরদার আমার পায়ের কাছে নিচে বসেছে। আমার
পা ধরে বারবার বলছে, "আমারে বর দেন আমারে বর দেন"
আমি বর দেবার কেউ না। আমি সামান্য মানুষ। সত্যিকার
হিমুর কিছু অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। সে তাকে সম্ভবত বর দিতে পারতো। কিন্তু আমি এখন না করলে
সে শুনবে না। আমি যে খুব সামান্য একজন সাধারণ মানুষ ছাড়া আর কেউ না তা সে বিশ্বাস করবে
না। আমার উদ্ভট কিছু বলে তাকে বুঝাতে হবে।
- টোকাই সরদার...
- জে মাটিপিতা, বান্দা হাজির।
- আজ জোছনা রাত।
এরকম ভরা পূর্ণিমায় যেদিন বৃষ্টি হবে সেদিন রাতে সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন অবস্থায় বৃষ্টিতে
ভিজতে হবে আর হেঁটে হেঁটে চাঁদ দেখতে হবে। যদি ঠিক ঠাক করতে পারিস তখন আমার বর এমনিতেই তোর উপর এসে পরবে।
- জে অবশ্যি। আমি অবশ্যি অবশ্যি করুম। দুইনা (দুনিয়া)
লণ্ডভণ্ড হইলেই করুম।
- আচ্ছা। আজকে যা।
- জে আচ্ছা। সেলাম।
সে ধীর পায়ে চলে গেলো। যাবার সময় আগের মত শব্দ
করে নয় বরং সিয়ামের মত নিঃশব্দে দরজা লাগিয়ে গেছে।
সিয়াম আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চাহনিতে স্পষ্ট
বিস্ময় আর একটাই প্রশ্ন, আমিও যদি এরকম করি তবে আমিও কি বর পাব?
সে মুখ ফুটে প্রশ্ন করতে পারে নি। আমিও মুখে কিছু
বলি নাই। চোখে শুধু প্রশ্রয় ছিলো।
* পাঠক, টোকাই সরদার আর ইদ্রিস এর জেল হাজতের ঘটনা
একটি বিশেষ পর্বে লিখবো।
[[কিংশুক২০১৫জুলাই২২সিরাজগঞ্জ২২৪১]]
সপ্তম প্রহর
আজ ঈদের
আগের দিন।
বাজারে উপচে পড়া
মানুষের ভিড়। শেষ মুহূর্তে মানুষের মনে পরেছে যে এটা ওটা কেনা এখনো বাকি। কিনতেই হবে। না কিনলে
কালকে কোরবানি দেয়া অসম্ভব।
শপিং মলের আনাচে কানাচে তারুণ্যের জোয়ার। বেশির ভাগের উদ্দেশ্যই শপিং না। তারা এসেছে মজা করতে।
আমি রাত ৯ টা পর্যন্ত হেঁটে বেড়িয়েছি রাজপথে। একটা
জিনিস লক্ষ্য করলাম। রাত যত গভীর হচ্ছে রাস্তায় নারী সংখ্যা বেড়ে চলেছে আর পুরুষ কমছে।
যুবকেরা যখন অনেক রাত হয়েছে বলে বাড়ি ফিরছে যুবতিরা তখন মাঠে নামছে। তবে তাদের বাইরেও
একটা দল আছে যারা আগে পরে সবসময় যুগলবন্দী। তাদের পৃথিবীতে প্রেরণের একমাত্র উদ্দেশ্য
হচ্ছে যুগলবন্দী অবস্থায় যত্রতত্র বসে বসে মধুর মুহূর্তের সৃষ্টি করা।
আমি আমার ছোট কুঠরিতে ফিরছি। আজকে রাতে মানুষ ঘুমাবে
না। তাই আজ আমার ঘুমানোর পালা।
একটা অন্ধকার চিপা গলির ভেতর ঢুকেছি। একটা একতলা
বাড়ির বারান্দায় ১০০ ওয়াট এর হলদে বাল্ব জ্বালানো। এখন কেউ এরকম বাল্ব ব্যবহার করে
না। সেই বাড়ীর পাশে রাস্তার দিকে একটা গাছ আছে। সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। কি গাছ জানা গেলে ভালো
হত। এই মুহূর্তে সুগন্ধি ফুলের গাছের নাম মনে করতে পারছি না। আমি গাছের নিকটবর্তী।
গাছ তীব্র গন্ধে আমাকে প্রায় অর্ধমাতাল করে ফেলেছে। দূরে আবছা আলোয় আমি একজন মানুষ
দেখলাম। সম্ভবত লাল শাড়ি পড়া। বাড়ির ভেতর থেকে একটা গান ভেসে আসছে। পুরনো গান। হেমন্ত
বাবুর সম্ভবত।
“ আমি দূর
হতে তোমারে দেখেছি
আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি
বাজে কিনি কিনি রিনিঝিনি
তোমারে যে চিনি চিনি
মনে মনে কত ছবি এঁকেছি”
হঠাৎ করে মনে হল আমি মেয়েটিকে চিনি। মেয়েটা রুপা।
কিন্তু রুপা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেক আগেই। সে তার সেলেব্রেটি স্বামীকে নিয়ে সুখে
আছে। তার এখানে থাকার কথা না।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত সাড়ে দশটা বাজে। সামনে
ল্যাম্পপোস্ট। একটা কুকুর ক্যু ক্যু শব্দ করে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। আমার মনে হল আমারও উচিত
দ্রুত পায়ে এলাকা ত্যাগ করা।
আমি আমার ঘরে ফিরলাম
রাত পৌনে ১২ টার দিকে। ঘামে ভেজা চপচপে পাঞ্জাবিটা খুলে রেখে খোলা জানার পাশে হেলান
দিয়ে বসেছি। আমার হাতে অসম্ভব সুন্দর একটা জিনিস। জিনিসটা একজন বিশেষ মানুষ দিয়েছিলো
বলেই সুন্দর। এমনিতে খুব সাধারণ একটা জিনিস। কিন্তু আমার কাছে অসাধারণ। একটা মোবাইল
ফোন। সেখানে রুপার নাম্বার সেভ করা আছে। এই জিনিসটার জন্যেই আজ রুপা আমার কাছে নাই।
অসম্ভব বড়লোক একজনকে বিয়ে করে সে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদিক থেকে ভালই হয়েছে।
মেয়েটা বেঁচে গেছে। কালকে ঈদ। ইচ্ছে করছে ফোন
করে বলি, “কেমন আছো
রুপা। আজকে ঈদ তাই উইশ করতে ফোন করেছি। তুমি কি বিরক্ত হয়েছো?”
ফোন করতে ভয় করছে। কিসের ভয়? হিমুদের তো ভয় থাকা
যাবে না। তবুও ভয় করছে। তারচেয়ে বরং একটা এসএমএস পাঠানো যেতে পারে।
আমি লাল বাটনে চাপ দিয়ে আলো জ্বালালাম। দুইটা মিসড
কল আর একটা এসএমএস।
রুপা দুবার ফোন করেছিলো। না পেয়ে একটা এসএমএস পাঠিয়েছে।
আমি এ জীবনে রুপার কল ধরতে পারলাম না। নিজের উপর খুব বিরক্ত লাগছে। এসএমএস এ হয়তো কিছু
জরুরী কথা বলা আছে। কিন্তু চিঠি পাওয়া মাত্রই পড়তে হয় না। কয়েক সপ্তাহ ফেলে রাখতে হয়।
তারপর পড়তে হয়। এতে চিঠি পড়ার একটা মজা আছে। অনেক জল্পনা কল্পনা মিশ্রিত চিঠি। এসএমএস
এর ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
আমার উচিত এসএমএস না পড়ে ফেলে রাখা। কিন্তু খুব
ইচ্ছে করছে রুপার এসএমএস টা পড়তে। আমার সাথে রুপার যোগাযোগ করার কোনোরূপ কারণ নাই।
খুব কষ্ট হচ্ছে। পুরানো স্মৃতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। সেই সব
মুহূর্তগুলো যখন সে আমার সাথে ছিলো।
হিমুদের দুঃখবোধ থাকতে নাই। হিমুরা সকল মানবীয়
আবেগ এর ঊর্ধ্বে। তবুও খুব কষ্ট হচ্ছে।
আমি তার জন্য পথ
চেয়ে থেকেছি বহু নিশিথ রজনী। তার একটা
এসএমএস অথবা ফোন কল মিস করবো না বলে রাতের পর রাত জেগে থেকেছি নির্বাক যন্ত্রটিকে হাতে
ধরে আর আজ সে যখন এসেছে আমি তখন নির্বাক।
আমি বোধয় হিমু হতে
পারবো না কোনো দিনও। আমি আমার প্রিয় ফোনটা জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম পঁচা নর্দমায়।
সে আমাকে কোনোদিন আর খুঁজে পাবে না। আর আমিও না।
তাকে আর বলা হল না, “কেমন আছো রুপা। আজকে ঈদ তাই উইশ করতে
ফোন করেছি। তুমি কি বিরক্ত হয়েছো?”
পৃথিবী খুব সুন্দর। সুন্দর পৃথিবী ঘুরিতেছে।
[[কিংশুক২০১৫সেপ্টেম্বর২৪সিরাজগঞ্জ২৩১৭]]
অষ্টম প্রহর - শেষ উপাখ্যান
বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি
হচ্ছে।
বৃষ্টির ছিটা আমার
মুখে এসে লাগছে। আমার ঘুম ভেঙ্গেছে শীতল মেঘের জলের স্পর্শে।
হাল্কা শীত শীত করছে।
খাটের উপর একটা কাঁথা থাকার কথা। সুন্দর ছবি আঁকা কাঁথার উপর। রুপা শখ করে বুনেছিল
আমার জন্য। ইদানীং ঢাকার মেয়েরা ঢং আর নেকামি ছাড়া তেমন কিছু পারে না। রুপা অন্যরকম
মেয়ে। যাই হোক আমি কাঁথাটা পাচ্ছি না। বালিশটাও নিখোঁজ। কাল রাতে চুরি হয়েছে। জানালা
খোলা পেয়ে ঢুকে গেছে। ঘরের ভেতর কাঁথা আর বালিশ ছাড়া নেয়ার মত কিছু না পেয়ে সম্ভবত
চোর হতাশ হয়েছে।
ঘরের ভেতরে ইউরিয়ার
গন্ধ। হতাশা থেকেই চোর এই কাজ করেছে।
বৃষ্টি কমেছে কিন্তু
থামেনি। আমি নীল পাঞ্জাবী টা গায়ে জড়িয়ে বের হয়েছি। হালকা বৃষ্টির মধ্যে হাঁটছি। হঠাৎ
একটা চিপা গলির মধ্যে থেকে একটা সূক্ষ্ণ সুর ভেসে আসছে বলে মনে হল। আমি গলিতে উঁকি
দিলাম। কিছুটা সামনেই একটা চায়ের দোকান। গান সেখান থেকেই আসছে। খুব পরিচিত গান,
“হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লাল দোপাট্টা মাল মাল কে, হো জি, হো
জি …”
আরে, বাকের ভাইয়ের
গান দেখি। আমি দ্রুত পায়ে চায়ের দোকানে গেলাম। উঁকি মেরে দেখি বাকের ভাই চাইয়ের কাপে
চুমুক দিচ্ছেন।
আমি বলে উঠলাম, বাকের
ভাই, আমাকে চিনেছেন?
-কি রে হিমু কেমন
আছিস?
- জি বাকের ভাই,ভালো।
আপনার অবস্থা কি?
-এইতো ভালোই আছি।
গান শুনছি।
আমাকে একটা এমপি
থ্রি দেখালো।
-বুঝলি হিমু, জিনিসটা
ভালো। মীরা কিনে দিয়েছে।
-বাহ, ভালোই তো।
- তা কই যাচ্ছিস তুই? দিনের বেলায় তো তোর বাইরে থাকার কথা না। তোর বের হবার সময়
তো রাত। নিশীথের আঁধারে; হিমু যায় আহারে।
- ইদানীং রাতে কম
বের হই। বয়স হয়ে যাচ্ছে।
- হাহাহা!!! তাই
নাকি। তা তোর রুপার খবর কি?
- সে বৈদেশ। ডাক্তার
স্বামী ধরে চলে গেছে আরো এক যুগ আগে।
- অ আচ্ছা। ভালই
করেছে। তোর সাথে থাকলে তো কাউকে মুখ পর্যন্ত দেখাতে পারতো না বেচারি। এখন তাও একটা
পরিচয় আছে।
- তা ঠিক।
আমি চলে এলাম। বাকের
ভাই একের পর এক চা খেয়েই যাচ্ছেন।
হাঁটতে হাঁটতে রমনার
দিকে চলে এসেছি। এখন আর বৃষ্টি পড়ছে না।
আমি ভেজা রাস্তায়
হাঁটছি। সবুজ গাছ দেখতে ভালো লাগছে। রাস্তায় খুব বেশি মানুষ নাই। বৃষ্টি বলে কপোত-কপোতীদের
আসরও সেভাবে জমে নাই। আমি নিজ মনে হেটে যাচ্ছি। হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়ে আমার কাছে ছুটে
এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো,
- Are you Himu?
- Yes
- Do you know
Rupa?
- Yes
- I'm Puti. Her
daughter.
- good
মেয়েটা আমার হাতে
একটা কাগজের টুকরো গুজে দিয়ে দ্রুত চলে গেলো। কাগজের টুকরোতে কিছু লেখা আছে বলে মনে
হচ্ছে। এখন পড়া ঠিক হবে না। চিঠি পড়ার কিছু নিয়ম কানুন আছে। পাঞ্জাবীর পকেট নাই বলে
আমি কাগজের টুকরোটা হাতে মুড়ে নিয়েই হাঁটতে থাকলাম।
আচ্ছা, রুপা কি স্বপরিবারে
দেশে এসেছে? তার ডাক্তার স্বামী কে নিয়ে সে তার কন্যাকে স্বদেশ ভ্রমণে এনেছে? কন্যা
কি আমার কথা জানে? নাকি রুপা আমার সাথে যোগাযোগের জন্য তাকে ব্যবহার করছে?
আমি হাঁটতে হাঁটতে
ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। যৌবনে অনেক হাঁটতে পারতাম। হিমু হবার অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। জানি
না কতটা হতে পেরেছি।
আমি নীল হিমু নই।
আমি কিংশুক। আমি চেয়েছিলাম হিমু হতে। পারি নি। আমি রুপার প্রেমে পড়েছিলাম।
আরো অনেক কিছুতে
ব্যর্থ হয়েছি। আমি শেষ পর্যন্ত হিমু হতে পারি নি।
আজ থেকে নীল হিমুর
প্রহর এর আর কোনো নতুন অধ্যায় লেখা হবে না।
নীল হিমুর অষ্ট প্রহর
এর ইতি।
দিন শেষে আমরা সবাই
হিমু হতে চাই।
[[[কিংশুক২০১৫অক্টোবর১০শান্তিবাগ,ঢাকা১৬৪১]]]
[[সমাপ্ত]]
No comments:
Post a Comment