এপিঠ ওপিঠ -- ‬উদয় হিমু

সকাল থেকে ফোনে বিড়ালের রিংটোন একটানা বেজেই যাচ্ছে। ফোন করেছেন ধানমন্ডি থানার ওসি কাউসার ফকির। ভদ্রলোক পুলিশ হয়েও এভাবে বিড়ালের মত মিউমিউ করছে কেন বোঝা যাচ্ছে না। অতি ক্ষমতাবানদের মিউমিউ শোনা সৌভাগ্যের ব্যাপার।কিন্তু প্রকৃতি তা সহজে গ্রহন করতে পারে না। তাই ফোনের চার্জ শেষ হয়ে ওসি সাহেবের মিউ মিউ বন্ধ হয়ে গেল।
কাল রাতে যখন থানায় ওসি সাহেবের রুমে ঢুকলাম, তখন উনি বিশাল মগে চা খাচ্ছিলেন। এই ভদ্রলোকের হয়তো চার্থাইটিস আছে। এই ধরনের লোকেরা পানি খাওয়ার মত চা খায়। চা এদের কাছে মাদকের মত। কিছুক্ষন চা না পেলে হাসফাস শুরু করে। তখন এদের খিচুনি শুরু হয়। মরন খিচুনি।
ওসি সাহেবের রুমে যখন ঢুকলাম তখন আমার পড়নে ছিল দামী কোট টাই। রুমটা সুন্দর করে সাজানো গোছানো। টেবিলের এক কোনে বড় একটা ফুলের দানি।হলুদ রঙের একটা ফুল। নাম মনে করতে পারছি না। হলুদ বৈরাগ্যের রং। সাধারনত ছেলেদের এ ধরনের পছন্দ থাকে না। এ থেকে বোঝা যায় স্ত্রীর পছন্দেই এ ফুল কেনা। এবং ভদ্রলোক তার স্ত্রী কে যথেষ্ট ভালবাসেন।
আমি রুমে ঢুকেই ওসি সাহেবের টেবিলে দুহাত রেখে চোখের উপর দিয়ে তার দিকে তাকালাম।
-কি খবর ওসি সাহেব? কেমন আছেন?
-হুম ভাল। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।
-চিনবেন চিনবেন। এত তাড়া কিসের? সবাইকে চিনতে হবে এমন তো কোন কথা নেই।
-আপনার কোন দরকার থাকলে বলুন। বাসায় যেতে হবে।
-স্ত্রী অপেক্ষা করছে। তাই তো? হুম। বিবাহবার্ষিকীতে একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া ভাল। স্ত্রীদের নিকট এই দিনটার বিশেষত্ব বেশি থাকে।
ওসি সাহেব এবার প্রথম হোচট খেলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের বিবাহবার্ষিকী আমার জানার কথা নয়। তাই তার চোয়াল ঝুলে পড়ল।
-আমার বিবাহবার্ষিকী তা আপনি জানলেন কিভাবে?
-ওসি সাহেব, তাড়াতাড়ি বাসায় যান। আপনার স্ত্রী পুষ্প আপনার জন্য বেগুনি শাড়ি পড়ে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। আপনার সাথে বরং কাল কথা হবে। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আপাতত তা খেয়ে নিয়ে বাসায় চলে যান। আপনার জন্য সুসংবাদ অপেক্ষা করছে।
তারপর আমার একটা কার্ড তার দিকে এগিয়ে দিলাম আর বললাম, 'এই নিন আমার কার্ড।আমি জানি আমাকে আপনার প্রয়োজন হবে। '
তারপর যেভাবে এসেছিলাম ঠিক সেভাবেই বের হয়ে গেলাম।ওসি সাহেবের হতভম্ব মুখটা একবার দেখতে ইচ্ছা করছিল। সব ইচ্ছা পূরন করতে হয় না। তবে তার মুখটা কল্পনা করতে আমার কোনো অসুবিধা হল না।
ওসি সাহেবের বিবাহ বার্ষিকীর খবর পাওয়া কাকতালীয় কিছু না। ফুলের দানির পাশেই একটা বেগুনি কলমে লেখা শুভেচ্ছা কার্ড ছিল। বিশেষ দিনে স্ত্রীরা স্বামীর পছন্দের বিষয় নিয়েই বেশি ভাবেন। আজও যে স্বামীর পছন্দের শাড়িটা পড়বেন তা বুঝতে জ্যোতিষ হপ্প্যার লাগে না। কিন্তু সুসংবাদের ব্যাপারটা কেন বলেছি জানি না। মুখে চলে এসেছে। সব কিছুর ব্যাখ্যা থাকে না।
মানুষকে হতভম্ব করতে একটা আলাদা আনন্দ আছে। তখন তাদের চিন্তাভাবনা গুলো এলোমেলো হয়ে যায়। ঠিকমত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ব্যাপারটা বিশাল আনন্দদায়ক।
ফোনে চার্জ দিয়ে সুইচ অন করার সাথে সাথেই ওসি সাহেবের ফোন। বোঝা গেল ভদ্রলোক এতক্ষন ধরে অনবরত চেষ্টা করেই গিয়েছেন। এবার সাথে সাথেই আমি ফোন ধরে নিলাম। অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর।আনন্দের বেলাতেও একই বিচার ভদ্রলোক অধিক আনন্দে পাথর হয়ে গেছেন। প্রথমবার ফোন ধরে কথা বলতে পারলেন না। পরে আবারো ফোন দিয়ে কাপাকাপা কন্ঠে বললেন,
-ভাই, আপনি কে?
-ওসি সাহেব, খুশির খবর পেয়েছেন?
-বাসায় গিয়েই শুনি আমার স্ত্রী গর্ভবতী। আমাদের বিয়ে হয়েছে ৯ বছর। অনেক ডাক্তার ফকির দেখানোর পরও কোনো কাজ হয়নি। কাল বাসায় ফিরে যখন খবরটা পেলাম তখন......
ওসি সাহেব কথা শেষ করতে পারলেন না। আনন্দে কেদে দিলেন। তারপর আবার বললেন,
-পুষ্প আপনাকে আজ আমাদের সাথে ডিনার করতে বলেছেন। আসবেন?
-ওসি সাহেব, এই সুসংবাদ টা আপনার জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ আনবে। পুষ্পভাবির দিকে খেয়াল রাখবেন।
আমি আর কিছু না বলে ফোন কেটে দিলাম। সিমটা খুলে বাইরে ফেলে দেব। ওসি সাহেব ফোন করেই যাবে। করুক।একসময় হয়তো পাগল হয়ে যাবে সে। এই দুঃসংবাদ এর কথাটাও আমি কেন বললাম জানি না। আনন্দ আর দুঃখ কখনো একা আসে না। প্রতিটা আনন্দের পেছনে যেমন দুঃখ কাজ করে,প্রতিটা দুঃখের পেছনেও আনন্দের হাত আছে। আনন্দ আর দুঃখে হয় কাটাকাটি। মানুষকে হতভম্ব করার ভেতর অদ্ভুত এক আনন্দ আছে।
পৈশাচিক আনন্দ।

জীবনমাল্য

লেখক ... .

No comments:

Post a Comment