——উদয় হিমু
জীবনের সর্বপ্রথম যেকোনো স্মৃতিই মনের
ভেতরে একটু বেশি জায়গা দখল করে থাকে। এমন এক
স্মৃতিই আজ হঠাত করে উঁকি দিল মনে। সময়টা সম্ভবত
১৯৬৮ সালের কোনো এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিন।
প্রতিদিনের মতই স্বাভাবিকভাবে শুরু হল দিনটা।
তবে স্বাভাবিকের মাঝেই অসাধারন এক
অনুভূতি খেলা করছিল মনে। জীবনের প্রথম নিজ
কর্মের ফসল হিসেবে বেতনটা হাতে পাব আজ।
অনেক স্বপ্ন আছে বেতনটা নিয়ে। বেতনের কোন
অংশটা কিভাবে খরচ করব সবই ঠিক করে রেখেছি।
বাবা ব্রিটিশ সরকারের ডাক বিভাগে পিয়নের
কাজ করত। সেই সুবাদে আমিও ডাক বিভাগেরই
ছোটখাট একটা পোস্টে চাকরি করছি।
বাবা মারা গেছেন মাস তিনেক হল। মৃত্যুর পর তার
পেনশনের টাকাটা উঠানো সম্ভব হয় নাই।
সরকারি কোন এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পেটেই
গেছে ওটা। পরিচিত প্রভাবশালী কেউ না থাকায়
দাবিও করতে পারি নি। মায়ের দশ বছরের
পুরনো শাড়িটার আচলের অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে।
আর শাড়ি না থাকায় এটা পড়েই দিন চালাতে হয়।
ভাবছি টাকাটা হাতে পেলে প্রথমেই মায়ের জন্য
ভাল দেখে একটা শাড়ি কিনব। ছোট
ভাইটা অনেকদিন ধরেই অংক একটা প্রাইভেট
পড়বে বলে বলছে। টাকার অভাবে পড়তে পারছিল
না। ও পাড়ার সুনীল স্যারের কাছে ওকে প্রাইভেট
পড়তে পাঠাব বলে ভাবছি। ছোট বোনের বান্ধবীর
বিয়ে। কিছুদিন ধরেই
দেখছি মনমরা হয়ে বসে থাকে। বান্ধবীর
বিয়েতে যাওয়ার জন্য তেমন ভাল কোন পোষাক
নেই ওর। অনেকদিন ধরেই বলছিল। দেব দেব করে আর
দেয়া হয়ে ওঠে নি। টাকাটা হাতে পেলে ওর জন্য
সুন্দর দেখে একটা কামিজ কিনব। একমাত্র
ছেলে তারেকের পায়ে একটু সমস্যা আছে। ঠিকমত
হাটতে পারে না। ডাক্তার বলেছে ১২ টাকা খরচ
করে একটা অপারেশন করালেই নাকি ঠিক
হয়ে যাবে। । আমার স্বপ্ন আমার ছেলেটা ডাক্তার
হবে। ফুটফুটে একটা নাতি হবে আমার।
নাতিটা যদি কোনদিন ভাল রেজাল্ট
করে তাহলে ডায়রিটা ওকে উপহার হিসেবে দেব।
কি জানি! হয়তো ও ডায়রিটা ছুঁয়েও দেখবে না।
চিন্তা করছি অপারেশন্টা এবার করিয়েই ফেলব। ওর
জন্য কম দামের মধ্যে লাল রঙের একটা হাফপ্যান্ট
কেনার ইচ্ছাও আছে। অনেকদিন ধরে বায়না ধরছিল।
সোনালিকে বিয়ের পর আর কিছু দেয়া হয়ে উঠেনি।
রহিমা খালার দোকান থেকে তিন
টাকা দিয়ে একটা নুপুর কিনে দেব।
ফর্সা পায়ে রূপালি নুপুর খুব মানাবে। শত স্বপ্ন
নিয়েই সাইকেলে করে অফিসে গেলাম।
সাইকেল্টা আমার দাদা ৭ বছর আগে বৃত্তির উপহার
হিসেবে আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। এখন ভালই
কাজে লাগছে। অফিসে যাওয়ার পর থেকেই
মনটা বাড়ির দিকে পড়ে ছিল।
অপেক্ষা করতে লাগ্লাম, কখন মায়ের
চোখে আনন্দের অশ্রু খেলা করতে দেখব, ছোট
বোন্টার হাসিভরা মুখটা দেখব,
ছেলেটাকে অনেকদিন পর ঠিকমত হাটতে দেখব,
সোনালির লজ্জামাখা গলায় শুন্তে পাব, “আমার
জন্য কেনার কি দরকার ছিল...” বড় সাহেবের কাছ
থেকে মাইনের ৮৫ টাকা হাতে পেয়েই রওনা হলাম
মার্কেটের উদ্দেশ্যে। মার্কেট থেকে সবার জন্য সব
কিছু কেনার পরও ৪৫ টাকা হাতে ছিল। আমার মন আর
মাঞ্ছিলনা। এই ৪৫ টাকা দিয়ে কি কি করব
তা ভাবতে ভাবতে যত দ্রুত সম্ভব
সাইকেলে প্যাডেল চালাতে লাগ্লাম। বড়
রাস্তার মোড়ে এসে হঠাত খেয়াল করলাম বিশাল
এক ট্রাম আমার দিকে ধেয়ে আসছে। এরপর সব
অন্ধকার। আর কিছু মনে নেই। শুধু টের পেলাম মায়ের
জন্য কেনা শাড়িটা কেন যেন ভিজে আছে।
ভেতরে একটু বেশি জায়গা দখল করে থাকে। এমন এক
স্মৃতিই আজ হঠাত করে উঁকি দিল মনে। সময়টা সম্ভবত
১৯৬৮ সালের কোনো এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিন।
প্রতিদিনের মতই স্বাভাবিকভাবে শুরু হল দিনটা।
তবে স্বাভাবিকের মাঝেই অসাধারন এক
অনুভূতি খেলা করছিল মনে। জীবনের প্রথম নিজ
কর্মের ফসল হিসেবে বেতনটা হাতে পাব আজ।
অনেক স্বপ্ন আছে বেতনটা নিয়ে। বেতনের কোন
অংশটা কিভাবে খরচ করব সবই ঠিক করে রেখেছি।
বাবা ব্রিটিশ সরকারের ডাক বিভাগে পিয়নের
কাজ করত। সেই সুবাদে আমিও ডাক বিভাগেরই
ছোটখাট একটা পোস্টে চাকরি করছি।
বাবা মারা গেছেন মাস তিনেক হল। মৃত্যুর পর তার
পেনশনের টাকাটা উঠানো সম্ভব হয় নাই।
সরকারি কোন এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পেটেই
গেছে ওটা। পরিচিত প্রভাবশালী কেউ না থাকায়
দাবিও করতে পারি নি। মায়ের দশ বছরের
পুরনো শাড়িটার আচলের অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে।
আর শাড়ি না থাকায় এটা পড়েই দিন চালাতে হয়।
ভাবছি টাকাটা হাতে পেলে প্রথমেই মায়ের জন্য
ভাল দেখে একটা শাড়ি কিনব। ছোট
ভাইটা অনেকদিন ধরেই অংক একটা প্রাইভেট
পড়বে বলে বলছে। টাকার অভাবে পড়তে পারছিল
না। ও পাড়ার সুনীল স্যারের কাছে ওকে প্রাইভেট
পড়তে পাঠাব বলে ভাবছি। ছোট বোনের বান্ধবীর
বিয়ে। কিছুদিন ধরেই
দেখছি মনমরা হয়ে বসে থাকে। বান্ধবীর
বিয়েতে যাওয়ার জন্য তেমন ভাল কোন পোষাক
নেই ওর। অনেকদিন ধরেই বলছিল। দেব দেব করে আর
দেয়া হয়ে ওঠে নি। টাকাটা হাতে পেলে ওর জন্য
সুন্দর দেখে একটা কামিজ কিনব। একমাত্র
ছেলে তারেকের পায়ে একটু সমস্যা আছে। ঠিকমত
হাটতে পারে না। ডাক্তার বলেছে ১২ টাকা খরচ
করে একটা অপারেশন করালেই নাকি ঠিক
হয়ে যাবে। । আমার স্বপ্ন আমার ছেলেটা ডাক্তার
হবে। ফুটফুটে একটা নাতি হবে আমার।
নাতিটা যদি কোনদিন ভাল রেজাল্ট
করে তাহলে ডায়রিটা ওকে উপহার হিসেবে দেব।
কি জানি! হয়তো ও ডায়রিটা ছুঁয়েও দেখবে না।
চিন্তা করছি অপারেশন্টা এবার করিয়েই ফেলব। ওর
জন্য কম দামের মধ্যে লাল রঙের একটা হাফপ্যান্ট
কেনার ইচ্ছাও আছে। অনেকদিন ধরে বায়না ধরছিল।
সোনালিকে বিয়ের পর আর কিছু দেয়া হয়ে উঠেনি।
রহিমা খালার দোকান থেকে তিন
টাকা দিয়ে একটা নুপুর কিনে দেব।
ফর্সা পায়ে রূপালি নুপুর খুব মানাবে। শত স্বপ্ন
নিয়েই সাইকেলে করে অফিসে গেলাম।
সাইকেল্টা আমার দাদা ৭ বছর আগে বৃত্তির উপহার
হিসেবে আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। এখন ভালই
কাজে লাগছে। অফিসে যাওয়ার পর থেকেই
মনটা বাড়ির দিকে পড়ে ছিল।
অপেক্ষা করতে লাগ্লাম, কখন মায়ের
চোখে আনন্দের অশ্রু খেলা করতে দেখব, ছোট
বোন্টার হাসিভরা মুখটা দেখব,
ছেলেটাকে অনেকদিন পর ঠিকমত হাটতে দেখব,
সোনালির লজ্জামাখা গলায় শুন্তে পাব, “আমার
জন্য কেনার কি দরকার ছিল...” বড় সাহেবের কাছ
থেকে মাইনের ৮৫ টাকা হাতে পেয়েই রওনা হলাম
মার্কেটের উদ্দেশ্যে। মার্কেট থেকে সবার জন্য সব
কিছু কেনার পরও ৪৫ টাকা হাতে ছিল। আমার মন আর
মাঞ্ছিলনা। এই ৪৫ টাকা দিয়ে কি কি করব
তা ভাবতে ভাবতে যত দ্রুত সম্ভব
সাইকেলে প্যাডেল চালাতে লাগ্লাম। বড়
রাস্তার মোড়ে এসে হঠাত খেয়াল করলাম বিশাল
এক ট্রাম আমার দিকে ধেয়ে আসছে। এরপর সব
অন্ধকার। আর কিছু মনে নেই। শুধু টের পেলাম মায়ের
জন্য কেনা শাড়িটা কেন যেন ভিজে আছে।
পরশিষ্টঃ
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। হিমেল আজ বৃত্তির
৩০০০ টাকা হাতে পেয়েছে। আজ আবার তার দাদুর
৪৫ তম মৃত্যুবার্ষিকি। স্কুল থেকে আসার পরই
বাবা তার হাতে একটা ডায়রি ধিরিয়ে দিলেন।
রাতে খাবার পর শোবার সময় বাবা মায়ের
মাঝে ডায়রীর শেষ হতে পড়তে শুরু করল সে। বাবার
মুখ থেকে শুনেছে তার দাদুর নাকি সত্যের
সাথে ফিকশন মিশিয়ে গল্প লেখার অসাধারন
ক্ষমতা ছিল। পৃথিবীটা আসলেই অদ্ভুত। হিমেল হঠাত
লক্ষ্য করল দাদুর লেখা শেষ গল্পটা কাকতালীয়
ভাবে প্রকৃতির কোন এক অদ্ভুত খেয়ালে নিজের
মৃত্যুর সাথে মিলে যায়। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
বিজলির হঠাত আলোতে ছেলের
চোখে পানি চিকচিক করতে দেখলেন
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নাক, কান,
গলা বিশেষজ্ঞ ড. তারেক হাসান। ছেলের
সামনে নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হতে লাগল
তার।
No comments:
Post a Comment