কল্পিত গল্প -কিংশুক

বৃষ্টি হচ্ছে । ঝুম বৃষ্টি।
রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে তন্ময়। রাস্তাটা একটা বিশাল জঙ্গলের পাশে । দুই পাশে যাচ্ছে তাই ধরনের ঝোপঝাড়। বড় বড় গাছ গাছড়া দের মহাসমাবেশ এখানে দিনের বেলাই অন্ধকার রাখে। আর এখন মধ্যরাত। চারপাশটা ঘুটঘুটে আঁধার । অনেকক্ষণ ধরে অন্ধকারে থাকায় চোখ মোটামুটি সয়ে গেছে। কোনো মতে হাটার মত দেখা যায়। হটাৎ হটাৎ নানা নানা ধরনের আওয়াজ আসছে জঙ্গল থেকে। ভয়ঙ্কর পরিবেশ তো বটেই। তন্ময় ভীত ছেলে নয়। সাহস ছাড়া জঙ্গলের এতটা পথ একা একা আসা যায় না। কিন্তু এটা বলা যাবে না যে ওর ভয় করছে না । বরং বেশ ভয় ভর করেছে তন্ময়ের উপর। ভেজা চুপচুপে শরীরে তবুুও হেটে যাচ্ছে তন্ময়।
এখানে এসে পুরা জঙ্গল। রাস্তা শেষ হয়ে গেছে। গহিন জঙ্গল হচ্ছে সবচেয়ে অনিশ্চয়তার স্থান। আর অনিশ্চয়তার দিকে মানুষ পা বাড়ায় নিরুপায় হয়ে। অনিশ্চয়তাও এক ধরনের মৃত্যু। বড় বড় গাছপালাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া সহজ নয়। পায়ের তলায় ঘাস পাতার আরেক মহাসমারোহ। তবুও সে এগিয়ে যায় অনিশ্চয়তার দিকে দুর্গম পথে।
হঠাৎ করে জঙ্গলের ভেতরে আলো আসতে শুরু করেছে। গাছ-পাতা গলে জোছনা ঝড়ে পড়ছে। আজ পুর্ণিমা। এখন আকাশে মেঘের ছিটাফোটাও নাই। সুন্দর চাঁদ আকাশে বলিষ্ঠ বিরাজমান। কে বলবে যে মিনিট পাঁচেক আগেও কালো মেঘেদের দল সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল গোটা আকাশে। গগণ গর্জে গর্জে বৃষ্টি হচ্ছিল। অন্ধকারের সে দৃশ্যে কানাও বলবে অশুভ অমাবস্যা । প্রকৃতি বড়ই হেয়ালি।
চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট জঙ্গলে ধীরে ধীরে পা বাড়াচ্ছে তন্ময়। খানিক্ষন যেয়ে থমকে দাড়াতে হল। বিশাল একখানা অশ্বথ গাছ। বেশ খানিকটা খালি জায়গা গাছের চারপাশে। অজ্ঞাত কারনে গাছের নিচে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কেউ যেন তার জন্যেই সব সাজিয়ে রেখেছে। এই গহিন জঙ্গলে কে এই কাজ করলো? যদিও ভাবনা উদ্রেগকারি প্রশ্ন তবুও সে সময় এখন নেই। অসার ক্লান্ত দেহ যে বিশ্রাম চায়। অবিশ্রান্ত পথিকের দেহে প্রানের সঞ্জিবন যেই ঘটাক না কেন এটার সত্যিই প্রয়োজন ছিল তন্ময়ের।
সাত পাঁচ না ভেবে গাছের নিচে গা এলিয়ে শুয়ে পরে সে। স্পষ্ট চাঁদ। সম্পুর্ণ গোল। অজস্র সাদা ধবধবে আলো। এরকম জোছনা স্নান খুব কম মানুষেরই ভাগ্যে থাকে । অশ্বথ বৃক্ষ তলে আধ শোয়া হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়েছিল তন্ময়। ভাবছিল বাড়ি ছেড়ে চলে আসার কথা। মায়ের সাথে সেই তুলকালাম ঝগড়া। বাবার সেই অপমান। তাদের রাগ, তাদের কষ্ট। স্কুলের কথাও মনে পড়ছে। মনে পড়ছে এসএসসি পরীক্ষার কথা। মনে পড়ছে রেজাল্টের দিনের কথা। সে কি উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা। সুখ সাগরের পেছনে সবার অলক্ষে শুধু অশ্রু মুছেছে সে।
আচ্ছা, একজন মানুষের পরিচয় কি শুধুই তার পরীক্ষার রেজাল্ট? মানব সভ্যতার একজন হিসেবে তার কি কোনো পরিচয় নেই? সে তো অন্য অনেক কিছুতেই ভাল। স্কুলের সেরা extra curricular activist । তার আর অনেক অনেক সুন্দর মানবীয় গুন আছে। অনেক ভাল ডিগ্রী ধারিদের যা নেই। এসবই কি নস্যি?
চোখের কোনার জলে চাঁদের আলো পরেছে। মুক্তার মত চকচকে সে অশ্রুজল। ভাবেছিল, বুঝি কেউ দেখেনি। কিন্তু সবার আড়ালে থেকে দেখেছে আকাশের অধিপতি। আর বহু দূর থেকে দেখেছে একজন সুদর্শনা নিশীথিনী। কেঁদেছে এক হারানো পথিকের সাথে। আড়ালে থেকে। চাঁদের মায়াময় আলোয় ঝলমল করা কিশোরের দিকে সে তাকিয়ে আছে বহু বহু দূর থেকে। ঘুমন্ত কিশোরের উপর তার যে মায়া পড়ে গেছে।
গভীর অরণ্যে রাত নেমে আসছে। বড়ই গভীর সে রাত।

Kingshuk

লেখক ... .

No comments:

Post a Comment