ক্রসফায়ারাক্রান্ত আমি ~~ফাইয়াজ ফাহিম

কোনও একদিন পুলিশ আমার বাসায় আসবে, গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাবে।এর পর কোনও এক জন মানবহীন খোলা ময়দানে পিছমোড়া করে হাতকড়া পরা আমাকে লাথি দিয়ে গাড়ি থেকে নামানো হবে। নিশুতি রাত, চারিদিকের নিশ্চুপ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ঝিঝি পোকার তারস্বরে চিৎকার ভেসে আসবে আমার কানে। দূরে কোথাও থেমে থেমে ডেকে ওঠা কুকুরের ডাক ভেসে আসবে। দিগন্তের ওপারে ঘনকালো গাঁয়ের সারি যেন গাছের চাদরে মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে সমস্ত জনপদ। পেছন ফিরে তাকালেই হয়তো দেখবো সুরম্য অট্টালিকার সারি। অধিকাংশ জানালার আলো নিভে গেছে, যে কয়টা জানালায় আলো জ্বলছে তাতে নেট পাগল কেউ হয়তো ফেসবুকিং করছে। স্ট্যাটাসে স্ট্যাটাসে তার দেশপ্রেম আর চেতনার ফুলঝুরি ঝরছে। অথবা কেউ ক্যারিয়ার গড়ার মানসে বিড় বিড় করে মুখস্থ করছে চোথা। কিংবা নীল ছবির অঙ্গনে ডুবে চুর হয়ে আছে কেউ। হ্যাঁ এ হয়তো শহরের শেষ আর গ্রামের শুরু, এমনি এক জনশূন্য অঞ্চল। গাড়ি থেকে নামিয়ে আমাকে বলা হবে "দৌড়ে পালা! পেছনে তাকালেই গুলি খাবি", আমি দৌড়বো, প্রাণপণে দৌড়বো।আমাকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে হবে! সে অনেক দুরের পথ। যেখানে মা তাঁর উষ্ণ আঁচল আগলে ধরে দু হাত
বাড়িয়ে আমার ফেরার অপেক্ষা করছেন। আহ! কি নিরাপদ সে মায়ের কোল। আমাকে সেখানে পৌছতেই হবে।কিছুতেই বিদ্যুৎ বেগে ছুটে আসা বুলেটের শিকার হওয়া চলবে না।তার আগেই আমাকে ফিরতে হবে। আমারতো অনেক স্বপ্ন আছে, অনেক কিছুই বাকি আছে। যে অচেনা কল্পিত নারীর মোহে ব্যাকুল হয়ে কবিতা লিখতাম, তাঁর সাথে তো দেখাই হল না, হল না দুটো কথাও। আমি ভেবে রেখেছিলাম রাত ভর দুজনে মিলে পুর্ণিমা স্নান করবো। কতো কথার কলকলানিতে কেটে যাবে রাত। ওর দীঘল কালো চুলের ফাঁক গলে উঠে আসবে স্নিগ্ধ দিবাকরের সোনালী আলো। আমাকে যে আর মাত্র কিছুদিন বেঁচে থাকতে হবে, আমার খুউববেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে। আমি প্রাণ পণে দৌড়চ্ছি, ওরা যদি পিছমোড়া করে হাতকড়াটা পরিয়ে না দিতো,তাহলে আরও অনেক জোরসে দৌড়াতে পারতাম। শীতের মৌসুম, মাঠের পানি নেমে যাওয়ার পরে যে কাঁদাপানি রেখে গেছে, সেখানে দৌড়ানো খুব কষ্টের। কিন্তু আমাকে তো বাঁচতে হবে। জানটা বুকে নিয়ে কোনও রকম ফিরতে পারলেই তো কষ্টের পালা শেষ। কাঁদাপানিতে বার কয়েক হোঁচট খেয়ে পড়ে যখন অক্ষম হয়ে গেলাম তখন আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে ভেসে এলো মরনাস্ত্রের আওয়াজ। খচ খচ করে কতগুলো কি যেন বিধে গেল
পিঠে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, ব্যথায় কুকরে উঠলাম, প্রচন্ডশীতে উষ্ণ রক্তধারার উত্তাপ আমার দেহের সাথে যখন জগতের নির্মমতম উপহাসটি করছে তখনও আমার মায়ের কোলে ফেরার ক্ষীণ স্বপ্নটা কেন যেন নিভে যায়নি। আমি ভাবছিলাম আমার পিঠে বিধে যাওয়া জিনিসগুলো কি হতে পারে!ওগুলো যে সরকারী টাকায় কেনা বুলেট ছিল তা বুঝে উঠতে উঠতে আমিও মুখথুবড়ে পড়ে গেলাম মাটিতে। নিথর হয়ে এলো দেহ।বন্ধ হল হৃদযন্ত্র। হঠাৎ ঝিক ঝিক ঝিক তালে ট্রেন ছুটে চলার শব্দ ভেসে আসে। রেললাইনের দু ধারে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোর ঘুম রেলগাড়ির এই বিকট শব্দেও ভাঙ্গে না। আমিও তো চিরতরে ঘুমিয়ে পড়লাম বিকট শব্দের তালেই। আহা! সে কি ঘুম। পিছুটান হীন এ ঘুম তার পেছনের কলুষিত রাজনীতি ও ঘৃনীত চেতনার থোড়াই কেয়ার করে। পরদিন যখন আমার মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে ফজরের সালাতে যাবার কথা তখনও আমার ঘুম ভাঙেনি। এ ঘুম তো ভাঙে না আর।



Unknown

লেখক ... .

No comments:

Post a Comment